প্রতি ইঞ্চি জমির সুষ্ঠু ব্যবহারে উন্নত জাতের হলুদ চাষ
কৃষিবিদ অসিত কুমার সাহা
বাংলাদেশের আয়তনের এক-দশমাংশ স্থান দখল করে রেখেছে বসতবাড়ি। দেশের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় রয়েছে বহুবর্ষী বৃক্ষ। তাছাড়া মৌসুমি সবজি চাষের জন্য রয়েছে মাচার ব্যবস্থা। বহুবর্ষী বৃক্ষের ও মৌসুমি সবজি চাষের জন্য জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। একে বহুবিধ ব্যবহারের আওতায় আনতে হলুদ চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ এরূপ ছায়াযুক্ত স্থানে, যেখানে অন্য ফসল চাষ করা অসম্ভব, সেখানে হলুদ চাষ করা যায় অনায়াসে।
অধিক জনসংখ্যার চাপে দিনদিন আবাদি জমি কমছে। এ প্রেক্ষাপটে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। এরই প্রেক্ষিতে স্বল্প পরিশ্রমে, অল্প ব্যয়ে, পানি জমে থাকে না, এমন ছায়াযুক্ত স্থানে অতি সহজে হলুদ চাষ করা সম্ভব। ছায়াযুক্ত পরিবেশে দেশি বা উন্নত জাতের হলুদ চাষ করা যায়। তবে উন্নত জাতের হলুূদ চাষে ফলন বেশি হয় এবং তাতে আয়ও বেশি হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, নানা জাতের হলুদ রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দুইটি জাতের হলুদ উদ্ভাবন করেছে। এ দু’টি জাত ডিমলা ও সুন্দরী। এ দু’টি জাতের চাষাবাদ পদ্ধতি প্রায় একই রকমের চৈত্র মাসের শুরু থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত হলুদ বীজ বপন করা যায়।
জমি প্রস্তুতকরণ ও বপন
হলুদ চাষে হলুদের কন্দ বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রতি হেক্টরে ২২০০ থেকে ২৪০০ কেজি কন্দের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি কন্দের দুটি চোখ জরুরি। ভালোভাবে জমি তৈরি করার পর দেশি লাঙ্গল বা বপনের জন্য হাতে টানা লাঙ্গল দ্বারা ৫০ সেন্টিমিটার দূরত্বে পাঁচ থেকে সাত সেন্টিমিটার গভীর করে ২৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে স্থাপন করতে হয়। এরপর দুই লাইনের মধ্যবর্তী জায়গা থেকে মাটি দিয়ে বীজ কন্দগুলোকে একটু উঁচু করে ঢেকে দিতে হয়। এতে দুই লাইনের মাঝে নালার মতো তৈরি হয় যা দিয়ে পানি সরে বা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা যায়। বীজ বপনের প্রায় একমাস পরে চারা গজায়। বহুবর্ষী বৃক্ষের ছায়ায় চাষের ক্ষেত্রে গাছ থেকে এমন দূরত্ব হলুদ চাষ করতে হবে যাতে শিকড় কাটা না পরে।
সার প্রয়োগ
হলুদ চাষে প্রতি হেক্টরে সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো- টিএসপি ১৮০ কেজি, এমওপি ২০০ কেজি এবং ইউরিয়া ২২০ কেজি প্রতি হেক্টর এসব সার ছাড়াও জমিভেদে হেক্টর প্রতি ৫ থেকে ১০ টন জৈব সার জমিতে প্রয়োগ করা যায়। শেষ চাষে টিএসপির পুরো অংশ এবং এমওপি সারের অর্ধেক প্রয়োগ করতে হয়। অতঃপর বীজ বপনের ৫০ থেকে ৬০ দিন পর আগাছা পরিষ্কার করে দুই সারির মাঝে অর্ধেক ইউরিয়া প্রয়োগ করে কোদাল দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে দিতে হয়। দ্বিতীয় উপরি প্রয়োগের আরও ৫০ থেকে ৬০ দিন পর বাকি এমওপি, ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হয়।
অন্যান্য পরিচর্যা
মাটি অধিক শুষ্ক হলে সেচের প্রয়োজন হতে পারে। প্রতিবার সেচের পর জমিতে জো আসার সাথে সাথে মাটির উপরের চটা ভেঙে দেওয়া উচিত। অতিবৃষ্টির সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গাছের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে, সময় মতো আগাছা দমন করতে হবে। গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হয়।
ফসল সংগ্রহ
হলুদ লাগানোর ৯ থেকে ১০ মাস পর যখন হলুদের কা- পর্যন্ত শুকিয়ে যায়, তখন হলুদ সংগ্রহ করতে হয়। সুন্দরী জাতের হলুদ, ডিমলা জাতের চেয়ে প্রায় একমাস আগে উত্তোলন করা যায়।
হলুদ গাছ ছায়া সইতে পারে। তাই বসতবাড়ির আঙিনায় ফল বাগানে হলুদের চাষ করা যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগানে অনেকে হলুদ চাষ করে বাড়তি লাভ করছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের জার্মপ্লাজম সেন্টারে দীর্ঘদিন ধরে বহু স্তরবিশিষ্ট ফল বাগানে নারিকেল ও লেবু গাছের নিচে হলুদ চাষ করে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া নারিকেলের সাথে পেয়ারা ও হলুদ চাষ করা যেতে পারে। পাহাড়ে হলুদ ক্ষেতের মধ্যে আন্তঃফসল হিসেবে শিমুল, আলু, ভুট্টা ইত্যাদি লাগানো হয়।
বালাই ব্যবস্থাপনা
হলুদ গাছের পোকার চেয়ে রোগের আক্রমণ বেশি হয় এবং এর মধ্যে হলুদের কন্দপচা রোগ প্রধান। তবে পাহাড়ে সম্প্রতি পাতা ঝরা রোগ ও অন্যান্য রোগ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে।
কন্দ পচা রোগ : কন্দ পচা এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগটি প্রায়ই হলুদ ক্ষেতে দেখা যায়। এ রোগের ফলে প্রথমে হলুদ গাছের গোড়ার দিকের পাতা হলুদ হতে শুরু করে। ক্রমে উপরের পাতাগুলো হলুদ হয়ে যায়। শেষে মাটির নিচে কন্দ পচতে শুরু করে। একপর্যায়ে পুরো কন্দ বা মোথাই পচে নষ্ট হয়। পচা মোথা থেকে দুর্গন্ধ বের হয়।
ব্যবস্থাপনা : জমি থেকে অতিরিক্ত পানি যাতে জমতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আক্রান্ত গাছ জমি থেকে তুলে ধ্বংস করতে হবে। রোগ দেখা মাত্র ক্ষেতে ছত্রাকনাশক (রিডোমিল গোল্ড, ডায়থেন এম ৪৫) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম পরিমাণ গুলে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে। ১৫ দিন পর পর তিন থেকে চার বার স্প্রে করলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বীজের জন্য রোগমুক্ত হলুদ গাছ থেকে কন্দ তুলতে হবে। আক্রান্ত জমিতে পরের বছর আর হলুদ চাষ করা ঠিক হবে না।
পাতা ঝলসা বা লিফ ব্লচ রোগ : এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের ফলে প্রথমে পাতা ফ্যাকাশে রং ধারণ করে। পাতার দু পাশেই ছোট ছোট অসংখ্য দাগ দেখা যায়। পরে দাগগুলো একত্র হয়ে পাতা ঝলসানো মতো দেখা যায়। শেষে আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে।
ব্যবস্থাপনা : এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আক্রান্ত পাতা জমি থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এ রোগ দেখা মাত্র ক্ষেতে ছত্রাকনাশক (ফলিকুর ১০ মিলি বা ২০ গ্রাম ডাইথেন এম ৪৫) প্রতি ১০ লিটার পানিতে গুলে ১৫ দিন পরপর তিনবার পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। বীজের জন্য অবশ্যই রোগ মুক্ত হলুদ গাছ থেকে কন্দ তুলতে হবে, কন্দ তোলার পর বীজ হিসেবে তা মজুদের আগে ব্যাভিস্টিন দিয়ে শোধন করে নিতে হবে।
পাতায় দাগ রোগ : সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এ রোগ বেশি দেখা যায়। নভেম্বর মাসে এ রোগে আক্রান্ত গাছের পাতা শুকাতে শুরু করে। এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের ফলে প্রথমে পাতায় ধূসর কেন্দ্র বিশিষ্ট বাদামি দাগ সৃষ্টি হয়। দাগের চারপাশে গাঢ় বাদামি বেষ্টনী থাকে, তার পাশে থাকে হলুদ রঙের আভা। ধীরে ধীরে দাগগুলো একত্রে মিলে বড় পাতাকে পুড়িয়ে ফেলে।
ব্যবস্থাপনা : এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আক্রান্ত পাতা জমি থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগ দেখা মাত্র ক্ষেতে ছত্রাক নাশক (ফলিকুর ১০ মিলি বা ২০ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫) প্রতি ১০ লিটার পানিতে গুলে ১৫ দিন পরপর তিনবার পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। কন্দ তোলার পর বীজ হিসেবে তা মজুদের আগে ব্যাভিস্টিন দিয়ে শোধন করে নিতে হবে। আক্রান্ত জমিতে পরের বছর আর হলুদ চাষ করা ঠিক হবে না।
হলুদ প্রক্রিয়াজাতকরণ : হলুদ কাঁচা ও শুকনো দুই অবস্থাতে বিক্রি করা যায়। শুকানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। হলুদ তোলার পর হলুদ পরিষ্কার করে একটি বড় পাত্রে প্রতি ১০০ কেজি কাঁচা হলুদের সাথে ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম খাবার সোডা মিশিয়ে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পানিতে সেদ্ধ করতে হয়। গরম পানি থেকে হলুদ উঠিয়ে ১২ থেকে ১৫ দিন কড়া রোদে শুকাতে হবে। শুকিয়ে গেলে শুকনো হলুদ হাতের চাপে মট করে ভেঙে যাবে। ভালোভাবে না শুকালে সেভাবে ভাঙবে না। শুকানোর পর তা হলুদ ভাঙানো কলে নিয়ে গুঁড়া করতে হবে। না করলে পলিথিনের বস্তায় ভরে ঘরের শুকনো জায়গায় মজুদ করে রাখতে হয়।
হলুদ বীজ উৎপাদন ও মজুদ ব্যবস্থাপনা : বীজ হলুদের জন্য ক্ষেত থেকে প্রথমে সুস্থ ও রোগমুক্ত গাছ থেকে হলুদ তুলতে হবে। তারপর সেগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করে মজুদের ব্যবস্থা নিতে হয়। মজুদের জন্য চালার নিচে সুবিধামতো কোন জায়গায় গর্ত করে গর্তের ভেতর চারপাশে শুকনো খড় বিছিয়ে থলিতে হলুদ ভরে মজুদ রাখতে হয়। তবে বালি দিয়ে মজুদ করা যায়। এজন্য প্রথমে হলুদ মজুদের জায়গায় তিন থেকে চার সেন্টিমিটার পুরু করে বালির স্তর বানাতে হবে। এরপর এর উপরে ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার পুরু করে হলুদ বিছাতে হবে। হলুদের উপর নিম বা বিষকাটালী পাতার পাতলা স্তর দিয়ে ঢেকে তার উপরে আবার ৩-৪ সেন্টিমিটার পুরু বালুর স্তর দিয়ে ঢেকে রাখলে ভালো হয়। এতে পোকার আক্রমণ কম হয়। এমনকি বীজ মজুদের আগে ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করে নিলে মজুদ করা কন্দের পচা কমে। বীজের পরিমাণ বেশি হলে এভাবে কয়েকটি স্তরে হলুদ রাখা যেতে পারে।
উৎপাদন খরচ ও আয় : স্থানীয় হলুদ চাষে হেক্টর প্রতি কৃষকের খরচ পড়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা এবং উৎপাদিত হলুদের স্থানীয় বাজার মূল্য পাওয়া যায় প্রায় এক লাখ টাকার বেশি, খরচ বাদে লাভ হবে ৭০-৭২ হাজার টাকা।
ব্যবহার : হলুদের ব্যবহার বহুমুখী। ভারতবর্ষে বহু আগের থেকে মসলা হিসেবে হলুদ ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। হলুদ প্রসাধনী সামগ্রী, রঙ, ভেষজ ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার হয়ে আসছে। শোনা যায় হলুদ দেহে রোগ প্রতিরোধ বাড়ায়। এ ছাড়া হলুদ বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়। বিভিন্ন রান্নাকে রঙযুক্ত আকর্ষণীয়, সুস্বাদু ও সুঘ্রাণ করতে গুঁড়ো হলুদ ব্যবহার হয়। হলুদের খাবার পচনকারী ব্যাকটেরিয়া জীবাণু ধ্বংস করতে পারে।
লেখক : প্রাক্তন উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গোপালগঞ্জ। মোবাইলঃ ০১৭১২-২৫৭০৬২,